সেদিন থানচি থেকে পেঁপে নিয়ে এসেছিল এক ছোট ভাই। দারুণ সুস্বাদু। খেতে খেতে বাবা বললেন, ‘পেঁপের বিচিগুলো তুলে রাখো। যাওয়ার সময় নিয়ে যাব।
—একটা সিরিঞ্জ হবে?
—থ্রি সিসি না ফাইভ সিসি?
—একটা হলেই হবে।
এমন মায়াভরা কণ্ঠ কত দিন শুনিনি! ঘাড় ঘুরিয়ে তোমাকে দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম।
পরে জানলাম, বছরখানেক আগে বাবাকে হারিয়েছ তুমি। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে কিছুদিন আগে তোমার ভাইয়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
হাসপাতাল এক অদ্ভুত জায়গা। এখানকার একেকটা ঢেউ অনেকের সব তছনছ করে দেয়। তিন বছর ধরে এই দুঃখের বন্দরে নিয়মিত নোঙর ফেলতে হচ্ছে আমাকে। কখনো মা, কখনো বাবা, কখনো বা ভাইয়ের ঠিকানা হয় এই হাসপাতাল।
তোমার চোখে তখন জলের জোয়ার। এ রকম পরিস্থিতি কিভাবে সামলাতে হয় জানা নেই আমার। তাই না পারছিলাম কাঁদতে, না পারছিলাম তোমাকে সান্ত্বনা দিতে।
সেদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। হুট করেই মনে হলো আজ যদি চলে যাই! পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার সময় কী রেখে গেলাম—হিসাব করতে গিয়ে দেখি আসলে তেমন কিছুই নেই! কিছু বই, মা আর বাবা। কিছু স্মৃতি, কিছু আক্ষেপ, কিছু দহন, কিছু দায়িত্ব। আর তুমি। কিন্তু কয়েক দিন আগে সেই বাবাও চলে গেলেন জীবন-নদীর অন্য পারে। জন্মের সময় তো আমরা কিছু নিয়ে আসি না দুনিয়ায়। মৃত্যুতেও সঙ্গে যায় না কিছুই। মাঝখানটায় ভালোবাসা পেলে তবু বলার মতো কিছু থাকে। নইলে প্রস্থানপত্রে কিছুই লেখার নেই! পরে মনে হলো, জীবনে তুমি এসেছ বলেই হয়তো জানতে পেরেছি, আমার এমন কোনো অন্তর্জগত্ এখনো আছে, যেখানে সেতু নামে একটি সংবেদনশীল মেয়ে বাস করে। চোখে যার কৌতূহল। অন্তর নির্মল। তাই বলছি, ‘অবেলায় যদি এসেছো আমার বনে দিনের বিদায় ক্ষণে। গেয়ো না, গেয়ো না চঞ্চল গান ক্লান্ত এ সমীরণে।’
‘খাবারটা রুমে দিয়ে আসছি। খেয়ে নিয়েন।’ বাড়ি থেকে বেরিয়েছি প্রায় দেড় যুগ হলো। বিশ্বাস করবে কি না জানি না, ইট-কাঠের এই শহরে এতগুলো বছরেও এমন মমতা ভরে কেউ খেতে অনুরোধ করেনি আমায়!
তোমার সঙ্গে যখন পরিচয় তখন আমার খুব খারাপ সময়। তবু অন্তরে প্রেম। মুখে নকল হাসি। দ্বিধার দোলাচলে তোমাকে বলতেও পারছিলাম না ‘ভালোবাসি’। কারণ তুমি বেজায় সুন্দরী, সরল এবং আন্তরিক। সৌন্দর্যের সঙ্গে কোথাও যেন একটা অচ্ছেদ্য যোগাযোগ আছে তোমার। মনে উদ্বেগ—বললেই তো হয় না! কিন্তু কল্পনায় তো কোনো কলঙ্ক নেই। সেই সূত্রে আমার হাঁড়ির সমস্ত খবর অযাচিতভাবে তোমাকে দিয়েছি। বোধ হয় নিজেকে সস্তা করে ফেলেছি। ভারি লজ্জা লাগে। বললে হয়তো বিশ্বাস হবে না—‘শরীর ছাড়াও ভালোবাসা হয়। বিয়ে না করেও বিবাহিত হওয়া যায়। বিয়ে করেও অবিবাহিত থাকা যায়।’
প্রিয় সেতু,
চক্ষুলজ্জায় যে কথা তোমাকে বলা হয়নি, সব আশঙ্কা উপেক্ষা করে আজ তা বলেছি। উচ্ছ্বাসগুলো আমাদের জীবনের বিজ্ঞাপন, গোপনীয়তা আমাদের সৌন্দর্য। তাই এই কথাটি গোপন রেখো। শুধু জেনো, তুমি আমার আরোগ্য নিকেতন, মলিন মনের আলতা। তুমি ভালো না থাকলে আমার ভীষণ খারাপ লাগবে। তোমার কোনো আয়োজনে না থাকলেও প্রয়োজনে সব সময় আমাকে পাবে। দয়া, মায়া, অনুকম্পা নয়, শুধু চাই সম্পর্কটা স্নিগ্ধ থাকুক। প্রীতির বন্ধনে উজ্জ্বল থাকুক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল